ছোটবেলা থেকেই রণজয় বড়ই চুপচাপ। বন্ধুবান্ধব বিশেষ নেই, আর যারা আছে, তাদের থেকেও খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে ও। ইন্ট্রোভার্ট দের এই এক স্বভাব, কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয়না। বলাই বাহুল্য, প্রেম ভালবাসার ধারপাশ দিয়েও যায়নি কোনদিন। কাউকে ভাললাগলে রীতিমত ধ্যান করে মনকে সরিয়ে এনেছে তার কাছ থেকে। কেন কে জানে - হয়ত মা-বাবার বকুনির ভয়, বা হৃদয় ভঙ্গের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে।
এহেন রণজয় যখন কলেজে উঠল, প্রথমবার স্বাধীনতার স্বাদ পেল। কী ভাবছেন, হিন্দি ছবির প্লটের মত এখানেই love at first sight & happily ever after হবে? না, এটা তো বাস্তব, এখানে সেসব খুব কম ক্ষেত্রেই হয়। আর যাদের হয়, তাদের মধ্যে রণজয়ের মত গোলগাল চুপচাপ ছেলের সংখ্যা নগণ্য। তার ওপর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেয়ের তুলনায় ছেলেরা সংখ্যায়ে এত বেশি যে, সেখানে কাউকে পাওয়া প্রায় statistically impossible।
ঠিক এই সময় বহ্নির সাথে পরিচয় হল। কলেজের একটা ক্লাবে নাম লেখানোর লাইনে পিছনেই দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা। কিছুটা ওর মতই চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের বলে মনে হয়েছিল রণজয়ের। কোথা থেকে এক অভূতপূর্ব আকর্ষণ যেন পেয়ে বসল তাকে। কোনভাবে কথা বলার সুযোগ খুঁজতে থাকে সে - সামনাসামনি না, মেসেজে। একদিন ক্লাবের সিনিয়ররা পিত্জা খাওয়াতে নিয়ে গেছিল। ফিরে এসে রণজয় মেসেজ করেছিল বহ্নিকে।
- "কটা খেলি?"
- "তিনটে"
- "বাপরে, তিনটে গোটা পিত্জা?"
- "না তিনটে স্লাইস।"
- "ও তাই বলি! আমি যদিও দুটো গোটা খেয়েছি।"
- "কত খেতে পারিস!"
বড় বোকা বোকা না? বোকা বোকাই তো। রণজয় নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে সেদিন কারোর সাথে কথা বলেছিল। আর বহ্নির সহজ সরল জবাবগুলো সেদিন মনে গভীর দাগ কেটে দিয়ে গেছিল। কথা বাড়তে থাকে ওদের মধ্যে। সিনেমা, সিরিজ, কেরিয়ার এসব নিয়েই কথা হয়। কি যেন এক অমোঘ টানে রোজ রাতে মেসেজ করে রণজয়। এক অদ্ভুত মুগ্ধতা কাজ করে যায় সে সময়। তবে মেসেজের বেশি যাওয়া হয়ে ওঠেনি আর। হারিয়ে ফেলার ভয়ে ডেকে সামনাসামনি মনের কথা খুলে বলা হয়নি আর। রণজয় কলেজ চত্বরে দিশাহীন ঘোরে একা একা, যদি কখনো দেখা হয়ে যায়। দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় সে, কি বলবে বুঝতে না পেরে। দেখতে দেখতে সেকেন্ড ইয়ার হয়। দুজনের ডিপার্টমেন্ট আলাদা। পড়ার চাপে ক্লাবেও আসা হয়না আর। আস্তে আস্তে কথাও কমে আসে।
রণজয় লক্ষ্য করে, সচরাচর বহ্নি আর নিজে থেকে কখনো মেসেজ করেনা, শুধু সে লিখলে উত্তর দেয়। একটু অভিমান হয় তার। সে চেষ্টা করে নিজে থেকে মেসেজ না করতে, কেরিয়ারে মনোনিবেশ করতে। কিন্তু পারেনা, গভীর নিস্তব্ধ রাতের নিঃসঙ্গতা হৃদয়ের উপর যখন চাপ সৃষ্টি করে, ওই দু লাইন মেসেজে একটু আরাম পায় সে।
ফাইনাল ইয়ার, ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরবার দিন, শেষবারের মত একবার দেখা করতে যায় রণজয়, একটু সাহস করেই। কলেজের পাশের পার্কে হাঁটতে হাঁটতে দুচার কথা হয়। বুঝতে পারে যে ফার্স্ট ইয়ারের পর দুজনেই অনেকটা বদলে গেছে। কথা বলার টপিক শেষ হয়ে যায় হাঁটা শেষ হয়ার আগেই। অস্বস্তিকর এক মৌনতায় শেষ হয় সে সাক্ষাৎ। পরদিন রণজয়ের আমেরিকা পাড়ি দেওয়ার দিন। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার জন্য অফার লেটার এসেছে কয়েক মাস আগেই। ভিসাও হয়ে গেছে। সোজা বাইশ ঘন্টা প্লেন জার্নি করে রণজয় পৌঁছে যায় নিউ ইয়র্কে।
* * * * * * * * * * * * * * *
আগস্ট ২০২৭। লাগার্ডিয়া এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে বহ্নির প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষ পাঁচ বছরের কথা ভাবছিল রণজয়। নিউ ইয়র্কের মধুচন্দ্রিমা পর্ব কাটতে লেগেছিল ঠিক এক সপ্তাহ। যান্ত্রিক সভ্যতায় রণজয়ের কথা বলার লোক বলতে ল্যাবের কজন, আর মা - বাবা। একা একা ঘুরতে যেতেও আর ভাল লাগেনা। ১০ বাই ১০ এর ছোট্ট ঘরটায় একাকীত্ব গলা টিপে শ্বাসরোধ করতে আসে। এমনই এক দিন আর থাকতে না পেরে বহ্নিকে আবার মেসেজ করে বসে রণজয়। এটা সেটা কথা হতে হতে হঠাত মনের সব কথা একদিন খুলে বলে সে। সেদিন কামদেব সদয় ছিলেন মনে হয়। বহ্নিও জানায় রণজয়কে ভাললাগার কথা।
সেই সম্পর্কের আজ পাঁচ বছর পূর্তি। পিএইচডি শেষ করে প্রফেসারের পদে সদ্য যোগ দিয়েছে রণজয়। বহ্নি ব্যাঙ্গালোর থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিউ ইয়র্ক আসছে। আজ রণজয় খুব খুশি। পাঁচ বছরের সাধনার পর আজ স্ক্রিনের ওপারে না, সামনাসামনি দেখতে পারবে একে অপরকে, বুক ভরে নিতে পারবে ঘ্রাণ, স্পর্শ করতে পারবে শরীর। পাঁচ বছর আগেকার মত কথার অভাব হবেনা এবার। ওইতো সামনের ডিজিটাল বোর্ডে প্লেন ল্যান্ড করার ঘোষনা করে দিয়েছে। এইবার আর মিনিট খানেকের অপেক্ষা। কিন্তু, কিন্তু ও কী গান বাজছে, কোথা থেকে বাজছে? সুরটা খুব চেনা...
অ্যালার্মটা বেজে উঠে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় রণজয়ের। পিঙ্ক ফ্লয়েড বাজছে, “How I wish, how I wish you were here. We’re just two lost souls swimming in a fish bowl, year after year….” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অ্যালার্মটা বন্ধ করে উঠে পরে রণজয়।